বাংলাদেশের টেক কোম্পানিগুলোতে কাজের সংস্কৃতি কেমন?যে কোনো কোম্পানীর দীর্ঘমেয়াদী সফলতার জন্য সঠিক এবং দৃঢ় কর্ম-সংস্কৃতির গুরুত্ব বলার অপেক্ষা রাখে না। বিগত বছরগুলোতে কর্পোরেট বিশ্বে এটি একটি অন্যতম আলোচিত বিষয়। সিলিকন ভ্যালির কোম্পানিগুলো কার্যকর কর্ম-সংস্কৃতি বিনির্মানে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার  বিনিয়োগ করছে।  অনেক কোম্পানি তাদের ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি ও সক্ষমতার কারণ হিসেবে কর্ম-সংস্কৃতির অবদানের কথা স্বীকার করে। কারণ যথাযথ কর্ম-সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানের টীমগুলোকে আক্ষরিক  অর্থেই ক্ষমতায়ন করে। টীমগুলো তাদের কাজের মাঝে অর্থবহতা খুঁজে পায় এবং প্রতিষ্ঠান ও কাজের প্রতি টীমের সদস্যদের মাঝে ভালবাসা তৈরি হয়।

বিশ্বের অধিকাংশ স্থানে টেক-কোম্পানিগুলোর কর্ম-সংস্কৃতি নিয়ে অনেক অালোচনা হলেও বাংলাদেশে এ ধরনের অালোচনা এখনো জনপ্রিয়তা পায় নি।কিছু কোম্পানি কর্ম-সংস্কৃতিকে অধিকতর গুরুত্ব  দিয়ে সেটাকে প্রতিদিনের চর্চায় পরিণত করতে বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ করে। অাবার কিছু কোম্পানি এর ধারও ধারে না। বেশিরভাগ সময়ই সঠিক কর্ম-সংস্কৃতির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে পার্থ্যক্য তৈরী করতে সহায়তা করে। । দুঃখজনক হলেও সত্য, যেসব কোম্পানি কর্ম-সংস্কৃতির গুরুত্ব বোঝে না, তারা এইচআর ডিপার্টমেন্টের  কাধে দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। তাদের ধারণা, কর্ম-সংস্কৃতি অাদতে “ধরা যাবে না ছোঁয়া  যাবে না” ধরনের  একটি বিষয় এবং প্রকৃত অর্থে গুরুত্বহীন।

যখন আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা বা সিইও-দের  সাথে কথা বলি, তখন নিজ থেকেই তাদের কর্ম-সংস্কৃতি প্রসঙ্গে জানতে চাই। বেশিরভাগ সময়ই এই অালোচনা চমৎকার মোড় নেয়। বিক্রয় ডট কম, সিওর ক্যাশ, ব্রেইন স্টেশন ২৩ এবং এস,এস,এল ওয়্যারলেস এর কর্ম-সংস্কৃতি এবং তাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মীরা কিভাবে কাজ করে তা নিয়ে তাদের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি। আমাদের কথোপোকথনের সারাংশ বিনির্মানের পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরা হল।

মিশা আলী বিক্রয় ডট কম’র মার্কেটিং ডিরেক্টর। সেখানকার কর্ম-সংস্কৃতি নিয়ে মিশা আলী বলেন:

“আমি যতগুলো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি তার মাঝে বিক্রয় হলো সবচেয়ে সমতল (Flat) সংগঠন। অামাদের কারো কোন নিজস্ব চেয়ার টেবিল নেই। আমার ম্যানেজিং ডিরেক্টর, অামি ও অামার টীম একই টেবিলে বসে খোলা অফিসে (Open office) কাজ করি।

আমি প্রতি সপ্তাহে ম্যানেজমেন্ট ও নিজস্ব টীমের সাথে বৈঠক করে পুরো সপ্তহের জন্য একটি কর্ম-পরিকল্পনা করি। প্রত্যেকের লক্ষ্য এক এবং আমরা সবাই একসাথে তার জন্য কাজ করি। যদি আপনার  কারো সাথে আলোচনা করার অথবা সহযোগিতার প্রয়োজন হয় তবে অাপনি নির্দ্বিধায় তার কাছে যাবেন এবং অাপনার প্রয়োজনের কথা জানাবেন। এক্ষেত্রে কোনো প্রকার শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধকতা নেই।

প্রত্যেকেই যেন তাদের কাজকে নিজের মনে করে সেটা নিশ্চিত করতে আমরা চেষ্টা করি। যে কোন কাজে কেউ বলে না যে এটা তার কাজ না, কারণ অামাদের সবার লক্ষ্য কিন্তু একটাই।

 

শাহাদাত খানে শিওর ক্যাশের সিইও।  শিওর ক্যাশের কর্মীরা কিভাবে কাজ করে এবং তাদের কর্ম -সংস্কৃতি কি সে সম্পর্কে ড. শাহাদাত  খান বলেন,

আমরা শিওর ক্যাশ এ একটি সাবলীল কর্ম-সংস্কৃতির চর্চা করি। এখানে যে কেউ যে কারো সাথে সহজেই যোগাযোগ করতে পারে এবং নিজস্ব সৃজনশীল  চিন্তা নিয়ে কাজ করতে পারে। অামরা চাই এভাবে আমাদের কর্মীরা তাদের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে।

অামাদের প্রতিষ্ঠানের মালিকানার একটা অংশ কর্মীদের জন্য বরাদ্দ অাছে। অামরা চাই আমাদের সহকর্মীরা অারো বেশি করে প্রতিষ্ঠানকে নিজের বলে মনে করুক।

সংগঠন হিসেবে অামরা সমতল কাঠামো (Flat Organogram) মেনে চলি। যে কোন নতুন অাইডিয়াকে অামরা অাইডিয়া প্রদানকারীর পদবী দিয়ে বিচার না করে তার কাজের সাথে গুরুত্বের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করি।

সাবলীল অান্তঃযোগাযোগ, দুর্দান্ত সব অাইডিয়ার অাদান-প্রদান, এবং কম অামলাতান্ত্রিকতা – এই হলো অামাদের মূল্যবোধ। অামরা সেরা মেধাদের নিয়োগ দেই এবং চেষ্টা করি তাদের সেরাটা বের করে নিয়ে অাসতে। এজন্য বিভিন্ন রকম পরীক্ষা নিরিক্ষা চালাতে অামরা দ্বিধা করি না। যখন কোনকিছুতে ব্যর্থ হই, অামরা জানি অামরা কিছু শিখতে পেরেছি। সফল হলে অামরা সেটা উদযাপন করি। বারবার চেষ্টার মাধ্যমে অামরা ক্রমাগত উন্নত হবার চেষ্টা করি।

 

আশীষ চক্রবর্তী এস,এস,এল ওয়্যারলেস এর সিওও। কিভাবে  এস,এস, এল ওয়্যারলেস কর্মীরা কাজ করে এবং তাদের কর্ম -সংস্কৃতি  সম্পর্কে  আশীষ চক্রবর্তী বলেছেন,

“অামাদের অর্গানোগ্রাম সম্পর্কে একটু বলি। এসএসএল’র প্রতিটি বিভাগ দেখাশোনার জন্য একজন করে ম্যানেজার অাছে। এই নির্বাহি কর্মকর্তা তার বিভাগের সবকিছুর সর্বময় কর্তা। যদিও উর্ধতন ব্যবস্থাপনা প্রতিটি বিভাগের বাজেট বরাদ্দ করে, তথাপি এই ম্যানেজার প্রতিটি অপারেশনাল সিদ্ধান্ত-গ্রহীতা।

এস.এস এল মূলত কর্মীদের দ্বারা চালিত সংগঠন। পরিচালকরা প্রায় কখনই দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ করেন না। নির্বাহি ম্যানেজাররাই লক্ষ্য স্থির করেন এবং আমরা সেই পরিকল্পনাগুলো এ.জি.এম সহ  বিভিন্ন বৈঠকে উপস্থাপন করি।

বাৎসরিক পরিকল্পনাগুলো অামরা অাগেভাগেই করে ফেলি। যেমন, আমরা ২০১৭ সালের পরিকল্পনা ২০১৬ সালের ডিসেম্বরেই করে ফেলেছি।

পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু নির্ণায়ক (KPI) রয়েছে। যেমন সেলস বিভাগের মূল  নির্ণায়ক (KPI) হলো টার্গেট ভলিউম, ফিনান্স এবং একাউন্টিং বিভাগের হলো ব্যয় কমানো।

দৈনিক কাজের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের বাৎসরিক টার্গেটকে দৈনিক ভিত্তিতে ভাগ করে নেই। এটা করার জন্য একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করি যেমন: সি.আর.এম যেখানে আমাদের কে.পি. আই নির্ধারণ করতে পারি। প্রতি বিভাগের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব হলো কে.পি. আই গুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা।

আমরা আমাদের সংগঠনে একটি জবাবদিতিহাপূর্ণ  পরিবেশ নিশ্চিত করি। কোম্পানির প্রত্যেকে একে নিজের বলে মনে করে, যেন তারা নিজেদের ব্যবসা পরিচালনা করছে। এবং আমরা কোনো প্রকার চাপ প্রয়োগে  বিশ্বাসী নই।

 

কিভাবে ব্রেইন স্টেশন ২৩ কর্মীরা কাজ করে এবং তাদের কর্ম-সংস্কৃতি সম্পর্কে এর প্রতিষ্ঠাতা রাইসুল কবির বলেছেন,

শুরু থেকেই যে বিষয়টি আমাদের খুব বেশি সাহায্য করেছিল সেটা হল  অামাদের ভিশন। আমরা এমন একটা লক্ষ্যে কাজ করছিলাম যেটা টাকা পয়সার চেয়ে বড় বা অামাদের নিজেদের থেকেও বৃহত্তর। শুধুমাত্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান না, অামাদের লক্ষ্য ছিল কর্মসংস্থান তৈরি এবং দেশের জন্য মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। তাই অামাদের কর্মীরা সবাই অনুভব করতো তারা মহত্তর কোন কিছুর সহযাত্রী।

এ ধরনের অনুধাবনের ফলে কর্মীরা দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের সাথে কাজ করে। আমাদের কর্মী টার্নওভার হার খুবই কম। আমাদের প্রথম কর্মী জার্মানীর উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়ে যাওয়ার দিন পর্যন্ত আমাদের সাথে কাজ করেছিল। এর মানে এটা নয় যে আমরা অনেক বেশি পারিশ্রমিক দেই। আমরা ভালো পারিশ্রমিক দেই কিন্তু আমরাই সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক প্রদানকারী কোম্পানি নই। আমরা সাধারণ কোম্পানিগুলোর চেয়ে ভালো পারিশ্রমিক দেই কিন্তু আমরা সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে কখনোই আমরা সর্বাধিক পারিশ্রমিক প্রদানকারী কোম্পানি হবো না কারণ আমরা ব্রেইন স্টেশন এ এমন কোনো কর্মী চাই না যারা উদ্দেশ্য ছাড়াই শুধুমাত্র অর্থের জন্য কাজ করে। বরং আমরা এমন কর্মী চাই যারা আমাদের নির্ধারিত ভিশন অর্জনে আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত।

আমরা কাজের পদ্ধতি বেশ অংশগ্রহণমূলক। আমরা কর্মীদের বলি যে এটা তোমাদের কোম্পানি। আমাদের ডেভেলপাররা সরাসরি আমাদের ক্লায়েন্টদের সাথে  কাজ করে, যেটা অাপনি বেশিরভাগ টেক কোম্পানিতে দেখবেন না এর কারণ হলো, অনেক কোম্পানিতে ডেভেলপাররা ক্লায়েন্টদের সাথে পরিচিত হবার পর তাদের কোম্পানি ছেড়ে চলে যায় কিন্তু ব্রেইন স্টেশন এমনটা কখনোই ঘটে না।  

স্বচ্ছতা একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ যেটা আমরা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে মেনে চলি। আমরা একটি ক্লায়েন্টকে কত বিল করি তা যারা একটি প্রকল্পে কাজ করে তারা প্রত্যেকে জানে। এটা কর্মীদের মাঝে বিশ্বাসের একটি মজবুত বন্ধন গড়ে তোলে। আমরা একটি সমতল কাঠামোবদ্ধ সংগঠন। এখানে কোনো স্যার বলার চল নেই। এমনকি  আমরা এই বিষয়টি অনুপ্রাণিতও করি না।