আপনি কি একজন উদ্যোক্তা? আপনি কি নিজের সময় ও শক্তি ব্যয় করছেন আপনার ব্রান্ডকে একটা টেকসই অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য। জার্মান ভোক্তা গবেষনা সংস্থা জিএফকে ২০১৭ সালের জন্য ১০টি ট্রেন্ড চিহ্নিত করেছে, যা পণ্য বা সেবা’র ব্রান্ডিং-এ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতে পারে।
জিএফকে’র মতে বর্তমান সময়ের ‘বিভক্ত’ দুনিয়ায় ভোক্তাদের মনযোগ পাওয়া ও ধরে রাখা কঠিনতম বিষয় এবং ক্রেতারা আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতনভাবে কেনাকাটা করে। তাই ঠিকভাবে ব্রান্ডিং করা খুবই জরুরী বিষয়। সঠিক ক্রেতাকে টার্গেট করা ও পণ্য ক্রয়ের প্রক্রিয়ায় তাদের সাহায্য করার মাধ্যমে তাদের জীবনকে সহজ করার মাঝেই ব্রান্ডিং এর সফলতা নিহিত।
নিচে জিএফকে’র চিহ্নিত ১০টি ট্রেন্ড সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো:
১. ক্রেতাদের জীবন সাজিয়ে দেয়া:
জিএফকে’র সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা গেছে আমেরিকার ভোক্তাদের কাছে গৃহস্থালী সম্পর্কিত সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ৫টি বিষয় হলো ঘর সাজানো, আসবাবপত্র, মালামাল রাখার জায়গা, পুরো বাসার আয়তন ও ডিজাইন এবং পরিচ্ছন্নতা। এদের মাঝে মার্কিন ভোক্তাদের কাছে ঘর সাজানো ও আসবাবপত্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মজার ব্যাপার হলো – এটি বিশ্বের বেশিরভাগ ভোক্তাদের জন্য সত্য। জিএফকে তাদের ২২টি দেশের ভোক্তাদের উপর গবেষনা থেকে এমনটা জানাচ্ছে।
এছাড়াও ভোক্তা নারী না পুরুষ তা এই ঘর সাজানো সংক্রান্ত পণ্য কেনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জিএফকে’র মতে নারীরা ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও আসবাব বদলাতে পছন্দ করে বেশি। অন্যদিকে পুরুষরা বাসার জিনিসপত্রের বিন্যাস ও খালি জায়গা নিয়ে নিরীক্ষা চালাতে বেশি আগ্রহী। এছাড়া বিশ্বজুড়ে পুরুষরা বাসা সংষ্কারেও তুলনামূলকভাবে বেশি আগ্রহী।
২. সেবায় মানুষের উপস্থিতি
ইন্টারনেটের মাধ্যমে আর্থিক পরামর্শ সেবার মতো যে সকল সেবা দূর থেকে দেয়া হয়, সেসব ক্ষেত্রে ক্রেতারা সত্যিকারের মানুষের কাছে থেকে সেবা পেতে আগ্রহী। উদাহরনস্বরুপ ক্রেতারা এসএমএস বা ইমেইলের তুলনায় একজন কল সেন্টার এজেন্টের সাথে কথা বলতে বেশি পছন্দ করে।
আর্থিক সেবামূলক ব্যবসার মতো যে সকল ব্যবসা বর্তমানে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে অল্প কর্মী দিয়ে বেশি ক্রেতাকে সেবা দিতে চায় তাদের জন্য এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ক্রেতারা এমনও বলেছেন যে তারা একজন মানুষের কাছ থেকে সেবা নেয়ার জন্য বেশি দাম দিতেও প্রস্তুত।
৩. আরো বেশি ভিডিও
আমেরিকার প্রতি ৬ জনে ১জন ভিডিও দর্শক নেটফ্লিক্সের মতো কোন না কোন স্ট্রিমিং সেবার নিয়মিত ক্রেতা। ভিডিও বা ছবি কোন বক্তব্য জানানোর জন্য বেশ শক্তিশালী মাধ্যম। তাই যারা কন্টেন্ট নিয়ে কাজ করেন, তাদের উচিত বিভিন্ন ডিভাইস প্রস্তুতকারকদের সাথে চুক্তিতে কাজ করা, যাতে তাদের কন্টেন্ট বা সফটওয়ার এসব স্মার্ট টিভি’র মতো ডিভাইসে আগে থেকেই দেয়া থাকে।
৪. দোকানে ক্রেতাদের দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা দেয়া
বর্তমানে অনলাইন ও অফলাইনে ক্রেতাদের কাছে যেকোন পণ্যের জন্য বিকল্পের অভাব নেই। তাই ক্রেতাকে ধরে রাখার জন্য আপনার অফলাইন বা অনলাইন দোকানে চমৎকার অভিজ্ঞতা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য জিএফকে’র পরামর্শ হল আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাতে ব্যবসায়ী হিসেবে আপনি বুঝতে পারেন একজন ক্রেতা কেন আপনার পণ্য কিনে অথবা না কিনে চলে যায়।
৫. মোবাইল কুপন দিয়ে বাজিমাত করুন
আমেরিকায় খাবার কেনাকাটার সময় মোবাইল কুপনের ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। এর মাধ্যমে ক্রেতা বেশ ভালই ছাড় পেয়ে থাকেন। এসব ক্রেতারা জানাচ্ছেন, ভাল দাম ও বেশি ছাড় পেতে তারা নতুন ব্রান্ড চেখে দেখতেও রাজি আছেন। এর মানে হলো, যদি আপনার ব্রান্ড নতুন হয়ে থাকে, তাহলে মোবাইল কুপন দিয়ে আপনি নতুন ক্রেতাকে আপনার পণ্য/সেবা পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করতে প্রলুব্ধ করতে পারেন। এটা শুধু নিম্ন আয়ের ক্রেতাদের জন্যই প্রযোজ্য না, বরং উচ্চ আয়ের ক্রেতারাও মোবাইল কুপনের নিয়মিত ভোক্তা।
বাংলাদেশে মোবাইল কুপনের সফল ব্যবহারের সাম্প্রতিক উদাহরন হলো উবার। উবার ডিসেম্বরের একটি কুপনের মাধ্যমে প্রথমবারের ব্যবহারকারীদের ২৫০ টাকা পর্যন্ত ছাড় দিয়েছে। বেশ সাড়াজাগানো এই কুপন ব্যবহার করে অনেকেই তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন। এতে উবার ব্যবহার না করা ক্রেতাদের মাঝে আগ্রহের সঞ্চার হয়েছে।
৬. ক্রেতাদের ক্রয়প্রক্রিয়া বুঝা
সফল ব্রান্ডকে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ক্রেতার পক্ষে ক্রয় প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপের তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। এর ফলে উদ্যোক্তা ক্রেতাদের পুরো “ক্রয়-পরিভ্রমন” বুঝতে পারবে, সাথে সাথে ক্রেতারা কোথায় সমস্যায় পড়েন বা দ্বিধাগ্রস্থ হন সেটাও বুঝতে পারবে। জিএফকে এজন্য ক্রয় প্রক্রিয়ার মাঝেই জরিপসহ অন্যান্য পদ্ধতি একীভূত করার জন্য পরামর্শ দিয়েছে।
৭. স্মার্টফোনকে কেনাকাটার সহকারী হিসেবে ব্যবহার করা
মোবাইল যেন পুরো দুনিয়াটাকে গিলে খাচ্ছে। স্মার্টফোন ব্যবহাকারীরা প্রায় সব কাজে তাদের পছন্দের ডিভাইসটিকে ব্যবহার করছেন। তাদের ফোনকে পণ্য খোঁজা, অনলাইন স্টোরে ব্রাউজ করাসহ নিজেদের পছন্দকে জমা করে রাখার কাজে ব্যবহার করেন। এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার ব্যবহারকারীরা মোবাইলকে তাদের প্রধান ‘শপিং-টুল’ হিসেবে ব্যবহার করছেন নিয়মিত। জিএফকে তাই ক্রয়-প্রক্রিয়ার মাঝে স্মার্টফোনকে একীভূত করার পরামর্শ দিচ্ছে। এটা চ্যানেল ঠিক করা থেকে শুরু করে মূল্য পরিশোধ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে হতে পারে, যাতে সবধরনের ক্রেতারা আরো সহজে কেনাকাটার মাধ্যমে নিয়মিত ক্রেতায় পরিণত হয়।
৮. ভোক্তাদের ‘চরম-স্বভাব’ কাজে লাগানো।
বর্তমানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ও ডিভিডি’র কল্যানে অনেক টিভি দর্শক টিভি সিরিজগুলোর কয়েকটি পর্ব একটানা দেখে ফেলেন। কখনো কখনো তারা সারাদিন ধরে একটি টিভি অনুষ্ঠান দেখেন বলে জানা গেছে। এভাবে টানা টিভি দেখাকে পশ্চিমা দেশগুলোতে Binge-watching বলে। যদিও এটা একটা অতি-প্রান্তিক আচরণ, তবুও সারা দুনিয়ায় টিভি দর্শকদের মাঝে এমন আচরণ লক্ষনীয়। জিএফকে জানাচ্ছে তাদের পরিচালিত জরিপে উত্তরদাতাদের ৫৭% উত্তরদাতা ২০১৬ সালে এরকমটা করেছেন, যেখানে ২০১৫ সালে এই হার ছিল ৫১%। বুঝা যাচ্ছে এটি একটি ক্রমবর্ধমান প্রবণতা। তাই জিএফকের পরামর্শ হলো ব্রান্ডগুলোকে এইধরনের প্রবণতা কাজে লাগানোর একটি উপায় বের করতে হবে যাতে এই নতুন ধরনের ক্রেতাদের কাছে পৌছানো সম্ভব হয়।
৯. কেনাকাটার চলতি প্রবণতা থেকে এগিয়ে থাকা
জিএফকে’র পরামর্শ হলো পয়েন্ট-অব-সেলস সহ অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে ক্রেতাদের ক্রয়ের ধারা বুঝা এবং বিভিন্ন ক্যাটাগরির মাঝে নিকট ভবিষ্যতে জনপ্রিয় হবার সম্ভাব্য পণ্যগুলো খুঁজে বের করা। এভাবে যেমন মার্কেট ট্রেন্ড বুঝা যাবে, তেমনি ক্রেতাকে আগাম সহায়তা করাও সম্ভব হবে।
১০. সেরা ব্রান্ডের জন্য ক্রেতাদের ভালবাসা চিহ্নিত করা
বেশিরভাগ সময় সেরা ব্রান্ডগুলোর সাথে ক্রেতারা অবচেতনভাবে জড়িয়ে থাকেন। যদি ক্রেতাদের কাছ থেকে সঠিক সময়ে পৌছানো যায়, তাহলে ব্রান্ড নিয়ে ক্রেতার আবেগঘন অনুভূতি জানা সম্ভব হবে। যেসব ব্রান্ড ক্রেতাদের কাছে এরকম আবেগের জায়গায় পৌছাতে চায়, জিএফকে তাদের ক্রেতাদের সাথে আন্তরিক আলাপচারিতায় যোগ দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছে।
লেখাটি সম্পাদনা করেছেন নাজমুল হাসান।