ratan-tataগত ২৮ ডিসেম্বর,২০১২, ভারতের সবচেয়ে বড় বিজনেস কংলোমারেটগুলোর একটি টাটা সন্স লিমিটেড এর চেয়ারম্যান এর পদ থেকে অবসর নিয়েছেন রতন টাটা। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চেয়ারম্যান হিসেবে থাকার পর নিজের ৭৫ তম জন্মদিনে তিনি তাঁর এই অবসরের ঘোষণা দেন।১৯৯১ সালে তাঁর চাচা বিখ্যাত শিল্পপতি জে আর ডি টাটা তাঁর হাতে টাটা পরিবারের দায়িত্ব তুলে দেন। সে সময় তিনি এই দায়িত্ব কতটুকু পালন করতে পারবেন সেটা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন গ্রুপের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ। সেই সন্দেহের হয়ত যথার্থ কারণও ছিল।সেই সন্দেহের যৌক্তিকতা কতটুকু ছিল বা আদৌ ছিল কিনা সেটা তাঁর দুদশকের নেতৃত্বে টাটা পরিবারের বিকাশ পার্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে।

রতন টাটা যখন টাটা গ্রুপের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন তখন ভারতীয় অর্থনীতি একটা অভূতপূর্ব সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। অর্থনীতির উদারীকরণ হচ্ছিল,বিপুল পরিমাণে বিদেশী বিনিয়োগ আশা শুরু হয়েছিল- এই পরিস্থিতির সর্বোচ্চ সুযোগ নেয়া এবং নিজেকে এই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়া ছিল সেই সময়ের বড়ো চ্যালেঞ্জ। রতন টাটা সেই চ্যালেঞ্জে উৎরে গেছেন ভালোভাবেই।

দায়িত্বের প্রথম দিকে আরেকটা চ্যালেঞ্জ ছিল টাটা গ্রুপের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে একই নেতৃত্বের অধীনে নিয়ে আসা। টাটা স্টিল, টাটা টী, টাটা কেমিকেলস, টাটা লাক্সারি ফাইভ স্টার হোটেল চেইন এই সব প্রতিষ্ঠান আগে জে আর ডি টাটার বিশ্বস্ত কয়েকজন সিনিয়র এক্সিকিঊটিভের নেতৃত্বে ছিল। রতন টাটা ধীরে ধীরে সেগুলো তাঁর নেতৃত্বে নিয়ে আসেন। তিনি সেই প্রতিষ্ঠান যেগুলো টাটা ব্র্যান্ডের নাম প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ব্যবহার করে ব্যবসা করছে সেগুলোকে বাধ্য করেন টাটা সন্সকে নির্দিষ্ট পরিমান রয়্যালটি দিতে। তিনি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কাজকর্মে দক্ষতা নিয়ে আসতে সক্ষম হন। টেক্সটাইলের মতো জেনেরিক ব্যবসায়ের দিক থেকে বিনিয়োগ ঊঠিয়ে বিনিয়োগ শুরু করেন প্রযুক্তি ব্যবসায়ের দিকে। সময়ের দাবীই ছিল এটি। কোম্পানির প্রবৃদ্ধি বেড়ে যায় অনেক গুন।

 এর পরের ধাপে রতন টাটা বিভিন্ন দেশি-বিদেশি কোম্পানি একুইজিশন শুরু করেন। সবচেয়ে আলোচিত একুইজিশনগুলো হলো-

২০০০ সাল – টাটা টী (এখন টাটা গ্লোবাল বেভারেজস) যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় চা কোম্পানি টেটলি গ্রুপ কিনে নেয়।

২০০৪ সাল – টাটা মটরস কিনে নেয় দক্ষিণ কোরিয়ার ডাইয়ু মটরস কে।

২০০৫ সাল- টাটা স্টিল সিংগাপুর ভিত্তিক ন্যাটস্টিল কোম্পানিকে কিনে নেয়।

২০০৭ সাল- টাটা স্টিল অ্যাংলো-ডাচ স্টিল জায়ান্ট কোরাস গ্রুপ পিএলসিকে কিনে নেয়।

২০০৮ সাল- টাটা মটরস কেনে লাক্সারি কার ব্র্যান্ড জাগুয়ার এবং ল্যান্ড রোভারকে।

২০১২- টাটা গ্লোবাল বেভারেজস স্টারবাকস এর সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চারে যায়।

এই একুইজিশন গুলোর মধ্য দিয়ে টাটা একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে পরিণত হয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে টাটার মোট আয়ের শতকরা ৫৮ ভাগই এসেছে দেশের বাইরে থেকে যেখানে দুই দশক আগে এর পরিমান ছিল মাত্র পাঁচ শতাংশ।

ইনোভেশনের দিক দিয়েও পিছিয়ে নেই রতন টাটা। ভারতের সবচেয়ে ইনোভেটিভ পানি শোধনকারী ব্র্যান্ড “ TaTa Swach” তার উদ্যোগেই বাজারে আসে। এটি প্রথমে একটি সেবামূলক উদ্যোগ হিসেবে থাকলেও বিপুল চাহিদার প্রেক্ষিতে ব্যবসায়ী উদ্যোগে পরিণত হয়। রতন টাটার সবচেয়ে আলোচিত ইনোভেশন হচ্ছে টাটা ন্যানো। ১০০০০০ রুপিতে কেনা যাবে এই ন্যানো কার। প্রথম দিকে এটা নিয়ে অনেক মাতামাতি থাকলেও সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা আর ন্যানো কারের কিছু অভ্যন্তরীণ যান্ত্রিক সমস্যার কারণে এর চাহিদা অনেক কমে যায়।

 রতন টাটার সাফল্যের স্বরুপ বোঝা যায় গ্রুপের আর্থিক ইন্ডিকেটরগুলোর দিকে তাকালেই। ২০১১-১২ অর্থবছর শেষে টাটা গ্রুপের এগ্রিগেট সেলসের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪.৫১ ট্রিলিয়ন রুপি ১৯৯২-১৯৯৩ অর্থবছরের তুলনায় যা ৪৩ গুন বেশি। একই সময়ের ব্যবধানে নেট প্রোফিট  ৫১ গুন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩,৬৬৪ কোটি রুপি। একই সময়ের ব্যবধানে গ্রুপের এগ্রিগেট মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের পরিমাণ ৩৩ গুন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৫৮ ট্রিলিয়নে।

অনেকের মতে রতন টাটর সফলতার পেছনে যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে সেটা সম্ভবত একই সাথে অনেক বড় এবং ছোট চিন্তা করার সামর্থ্য। সমাজের উচ্চবিত্তকে টার্গেট করে যেমন পণ্য এবং সেবা তৈরি করেছেন তেমনি একেবারে প্রান্তিক এবং মধ্যবিত্তের জন্যও সরবরাহ করেছেন প্রয়োজনীয় পণ্য এবং সেবা।নিউইয়র্ক টাইমসের এক নিবন্ধে তাঁকে দেখা হয়েছে এভাবেই-“মিঃ টাটা সেই খুব কম মানুষদের একজন যারা ভারতীয়দের মন এবং প্রয়োজন দুটোই খুব নিখুঁতভাবে বুঝতে পেরেছেন এবং সফলভাবে ব্যবসা করতে পেরেছেন এই প্রজ্ঞাকে ব্যবহার করে। বিশাল জনগোষ্ঠীর সামর্থ্যের ভিতরে তাদের কাঙ্খিত পণ্য তৈরি করাই যে ব্যবসায়ের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।  এক লাখ রুপির ন্যানো কার, বিদ্যুৎ ছাড়াই পানি শোধন করার যন্ত্র তৈরি তাঁর এই প্রজ্ঞার প্রমাণ।”

ব্যক্তিগত জীবনে খুব বিনয়ী মিঃ টাটা নিজের ভুল সিদ্ধান্ত কোম্পানির উপর চাপিয়ে দিতেন না বরং সরল স্বীকারোক্তি করতেন। জন্মগ্রহণ করেন টাটা পরিবারেই ১৯৩৭ সালে মুম্বাইতে। আর্কিটেকচারের উপর স্নাতক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের করনেল ইউনিভার্সিটি থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের একটা আর্কিটেকচার ফার্মে কিছুদিন কাজও করেছেন। এরপর ১৯৬২ সালে জামশেদপুরে অবস্থিত টাটা স্টিল লিমিটেড এ শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯১ সালে যখন টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তখন তাঁর বয়স ৫৪ বছর।ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাচেলর মিঃ টাটা ভারতের সর্বোচ্চ উপাধি পদ্মভূষণ এবং পদ্মবিভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন।